প্রকৃতপক্ষে বাংলা ও ভারতের সমগ্র অংশ যেন ইসলাম আগমনের জন্য বসেই ছিল। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল ভারতের তৎকালীন সমাজব্যবস্থা। জাতপাত ও অন্যান্য সামাজিক বিষয়ে মানুষের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর চোখে সে যুগের সমাজ দর্শনটি ধরা পড়েছে এভাবে :
...‘আর্য’ শব্দের অর্থ হলো ভদ্রলোক এবং শ্রেষ্ঠ মানুষ।...তারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিত কৃষিকে।... কৃষিক্ষেত্রে এবং দৈনন্দিন জীবনে ষাঁড় ও গাভি ছিল খুবই উপকারী। গাভি প্রতিদিন দুধ দিত বলে এগুলোর কদর ছিল আরো বেশি।...দীর্ঘকাল পরে গরু বা গাভিকে যত্ন করার আসল কারণ ভুলে গিয়ে গরুকে পূজা করা শুরু করল...। (জওয়াহেরলাল নেহরু : মেয়ের কাছে বাবার চিঠি, দ্যু প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭, পৃষ্ঠা ১০১-১০২)
এভাবে ভারতের স্থানীয় ধর্মে যা আর্যদের মাধ্যমে বাইরে থেকেই এসেছিল, তাতে বিকৃতি ঘটতে থাকল। এর প্রভাব সমাজেও লাগল। সমাজ ভেঙে যেতে লাগল। সমাজ ভেঙে যাওয়ার পেছনে আরো বড় যে বিষয়টি ধাক্কা দিয়েছিল, তা হলো জাতপাতে সমাজের মানুষকে বিভক্ত করে রাখা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রাচীন ভারতীয় সমাজ-দর্শনের এ পর্যায়ে লিখেছেন :
আর্যরা নিজেদের নিয়ে খুব অহংকার করত। ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতি বা গোত্রের সঙ্গে যাতে মিশে না যায়, সে বিষয়ে তারা যথেষ্ট সচেতন ছিল। মেলামেশা বন্ধ করতে তারা নিয়ম করল, আইন করল যাতে অন্য গোত্রের কাউকে কেউ বিয়ে না করতে পারে। এই নিয়মের সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে জাতপ্রথার সৃষ্টি হলো। (নেহরু : মেয়ের কাছে বাবার চিঠি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০১-১০২)
আর্যদের এই সূত্র ভারতের হিন্দু সমাজকে খণ্ডবিখণ্ড করে দেয়। ৩৬টি জাতপাতে বিভক্ত ছিল বাংলার মানুষ। খণ্ডবিখণ্ড হয়ে এভাবে সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে। পরস্পর অবিশ্বাস ও ঘৃণা সমাজের মানুষকে পঙ্কিলতায় ডুবিয়ে দেয়। এমনই একটি সময়ে খ্রিস্টীয় ছয় শ শতকে বাংলা-ভারতে ইসলাম এসে দরজায় কড়া নাড়তে থাকে। ইসলামে জাতিভেদ তো ছিলই না, বরং ছিল মানুষকে একে অপরের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলার আবেদন। ছিল না ছোট-বড় তা অর্থ-সামর্থ্য সব দিক থেকেই। ছিল সাম্য-চেতনা। ফলে ইসলামের আবির্ভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ দেখা দিল। দ্রুতই সাধারণ সমাজে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল। (এনামুল হক ও আবদুল করিম : আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য, পৃষ্ঠা-৩)
জাতিভেদ প্রথায় মানুষের প্রতি মানুষের যে অবজ্ঞা প্রকাশিত হয়, তাতে উচ্চ শ্রেণির হিন্দুদের দ্বারা সাধারণ হিন্দুরাই নয় শুধু, সমাজ-মানুষ হিসেবে বৌদ্ধরাও এর শিকার হয়েছিল। ফলে আরব বণিকদের কাছ থেকে পাওয়া ইসলাম খুব দ্রুতই বাংলায় ছড়িয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কারণ ঢাল-তলোয়ার ছাড়াই আরব বণিকরা ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। সিংহাসনে থেকেই অনেক রাজা, ভূস্বামী এবং সমাজপতিও ইসলামের দাওয়াতকে কবুল করে নেন।