IQNA

সোনালি যুগে স্পেনের মুসলিম মনীষা

17:19 - June 15, 2021
সংবাদ: 2612963
তেহরান (ইকনা): ইসলাম আগমনের এক শতাব্দীকাল অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই ইউরোপের স্পেনে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রায় আট শ বছর মুসলিমরা স্পেন শাসন করে।

মুসলিম শাসনামলে স্পেন সমগ্র মানবসভ্যতার জন্য আলোর বাতিঘরে পরিণত হয়। মুসলিম স্পেন প্রদীপ্ত করে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকাকে। তাদের হাতেই সূচিত হয় শিল্প ও সাহিত্য, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের নতুন অধ্যায়ের।


মুসলিম স্পেনে জ্ঞানবিপ্লব

খ্রিস্টীয় দশম ও একাদশ শতকে মুসলিম স্পেন উন্নয়ন ও উৎকর্ষের শীর্ষ চূড়ায় আরোহণ করে। এ সময় মুসলিম প্রতিটি শহরে শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চায় চরম উৎকর্ষে পৌঁছায়। যেমন কর্ডোভার রাজকীয় পাঠাগারে দুই লাখ বই ছিল। জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ইউরোপের শীর্ষ বিদ্যাপিঠ। কর্ডোভা থেকে চার মাইল দূরে অবস্থিত ‘কাসরে জাহরা’ ছিল স্থাপত্যশিল্পের বিস্ময়। অনুরূপ গ্রানাডায় একটি শক্তিশালী দুর্গ গড়ে উঠেছিল, যার ফটক ছিল ২০টি এবং এক হাজার বুরুজ ছিল। উত্তর স্পেনে গড়ে উঠেছিল ইউরোপের অন্যতম প্রধান সামুদ্রিক বন্দর। পাহাড়ের ওপর গড়ে উঠেছিল অনিন্দ্যসুন্দর আল হামরা শহর। জ্ঞান, বিজ্ঞান, কৃষি, অর্থনীতি, সামাজিক নিরাপত্তা ও সামরিক সামর্থ্য সব কিছুতে স্পেনে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছিল; বরং এতটাই পরাক্রম হয়ে উঠেছিল যে তৎকালীন ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ স্পেনে আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে।

 

যাদের হাতে মুসলিম স্পেনের জ্ঞানবিপ্লব

মুসলিম স্পেনের এই অসামান্য সাফল্যের পেছনে রয়েছে বিশ্ববরেণ্য কয়েকজন মনীষীর অসামান্য ত্যাগ ও সাধনা। এমন কয়েকজন মুসলিম মনীষীর পরিচিতি তুলে ধরা হলো—

১. আরিব ইবনে সাআদ : কর্ডোভার স্বর্ণযুগখ্যাত খ্রিস্টীয় দশম শতকে আরিব ইবনে সাআদ আল-কাতিব কুরতুবির জন্ম (৯১০ খ্রি.)। তিনি খ্রিস্ট ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামে দীক্ষিত হন। তিনি একই সঙ্গে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও ঐতিহাসিক ছিলেন। আফ্রিকা ও স্পেনের গ্রহণযোগ্য মুসলিম ইতিহাস রচনায় তার অবদান অসামান্য। কর্ডোভার শাসক আবদুর রহমান নাসিরের আমলে রাজকীয় চিকিৎসক ছিলেন। নারী ও শিশু চিকিৎসা বিষয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞানেও গুরুত্বপূর্ণ রচনা রয়েছে। ৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।

২. আবুল কাসিম মুসলিমা বিন আহমদ মাদ্রিদি : ৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রিদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও আবদুর রহমান নাসিরে পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞানচর্চা করেন। জীব বিজ্ঞান, ভৌত বিজ্ঞান ও রসায়ণ শাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন। ধারণা করা হয়, তাঁর রচিত ‘মুআমালাত’ গ্রন্থটি ব্যবসায়িক হিসাব বিজ্ঞান (Commercial Arthimetics) বিষয়ক প্রথম বই। এই বই তাঁকে ইউরোপের বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। রসায়ণ বিষয়ে তিনি রচনা করেন ‘গায়াতুল হাকিম’ নামক অনবদ্য একটি গ্রন্থ। এই বই দুটি ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয় এবং ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকাভুক্ত হয়। এ ছাড়া আবুল কাসিম মাদ্রিদি প্রাণিবিদ্যার ওপরও একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ১০০৭ খ্রিস্টাব্দে কর্ডোভায় ইন্তেকাল করেন।

৩. আবুল কাসেম খালাফ ইবনে আব্বাস জাহরাভি : তিনি ছিলেন সমকালের বিখ্যাত চিকিৎসক ও আধুনিক সার্জারি বা অস্ত্রপচার বিদ্যার জনক। তিনি ৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে মদিনাতুজ জাহরায় জন্মগ্রহণ করেন। কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা সমাপনের পর রাজকীয় চিকিৎসালয়ে নিয়োগ পান। তাঁর রচিত ‘আত-তাসরিফ লি-মান আজিঝা আনিত তাসিফ’ সার্জারি বিষয়ক প্রথম গ্রন্থ। এই বইয়ে তিনি মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সচিত্র বিবরণ তুলে ধরেছেন। ইউরোপের একাধিক ভাষায় বইটি অনূদিত হয় এবং কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত তা ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকাভুক্ত ছিল। তিনি ১০৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।

৪. আবু দাউদ সুলায়মান ইবনে হাসান : কর্ডোভার খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক ছিলেন। দাদার সঙ্গে যুক্ত করে তাঁকে ইবনে জালজাল বলা হতো। মানবদেহ ও রোগতত্ত্বের ওপর একটি বিশ্লেষণধর্মী বই লিখে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। তাঁর রচিত ‘তারিখুল আতিব্বা ওয়াল ফালাসাফা’-কে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইসলামী যুগের প্রথম গ্রন্থ মনে করা হয়। ইবনে জালজাল ১০১০ খ্রিস্টাব্দে কর্ডোভায় মারা যান।

৫. ইবনুল ওয়াফা : আবুল মুতরিফা আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনুল ওয়াফা ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ত্লিতলা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রোগতত্ত্ব বিদ্যায় পণ্ডিত ছিলেন। ‘কিতাবুল আদবিয়া ওয়াল মুফরাদা’ তাঁর বিখ্যাত রচনা। ১৫৪৯ খ্রিস্টাব্দে বইটির ল্যাটিন অনুবাদ প্রকাশিত হলে তা ব্যাপক সুনাম অর্জন করে। ইবনুল ওয়াফা ১০৭৪ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।

৬. ইবনে খালদুন : মুসলিম স্পেনের আশবিলা শহরের অধিবাসী আবু মুসলিম ওমর ইবনে আহমদ ইবনে খালদুন কালজয়ী মুসলিম দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী। দর্শন ও সমাজবিজ্ঞান ছাড়াও তিনি চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা ও প্রকৌশল বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তাঁর রচিত ‘তারিখ’ ও ‘মুকাদ্দিমা’ বিশ্বের বহুল পঠিত বইগুলোর অন্যতম। বিশ্ববিখ্যাত এই মনীষী ৪৪৯ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।

৭. ইবনে বাজাহ : তাঁর পুরো নাম আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহইয়া। জীবনকাল ১০৮৫-১১৩৮ খ্রিস্টাব্দ। ইবনে বাজাহ ছিলেন স্পেনের একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। এ ছাড়া তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান, নক্ষত্রবিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যায় অভিজ্ঞ ছিলেন। হাফেজে কোরআন ছিলেন এবং আরবি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে সম্যখ ধারণা রাখতেন। তিনি মরক্কোয় ইন্তেকাল করেন। ইসলামী দর্শনে আবু নাসির ফারাবির পর তাঁকে সবচেয়ে বড় দার্শনিক মনে করা হয়।

৮. আবুল আব্বাস ইবনে রুমিয়া : আশবিলা শহরের অধিবাসী এই পণ্ডিত ছিলেন একজন চিকিৎসক ও উদ্ভিদবিদ। বিভিন্ন ওষুধের পরিচয়, বৈশিষ্ট্য, গুণাবলি ও ভিন্নতা বিষয়ে তার বিশেষ দক্ষতা ছিল। উদ্ভিদ বিষয়ে গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের জন্য পুরো স্পেন, পশ্চিমা আফ্রিকা, মিসর থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত চষে বেড়ান। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। ইলমে হাদিসে বিশেষ জ্ঞান রাখতেন।

৯. আবু ইসহাক জারকানি : আবু ইসহাক ইবরাহিম ইবনে ইয়াহইয়া নাক্কাশ জারকানি ১০২৯ খ্রিস্টাব্দে কর্ডোভাতে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে ত্লিতলার মামুন শাহের দরবারে কর্মজীবন শুরু করেন। জারকানি ছিলেন সমকালের প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিদ। জ্যোতির্বিজ্ঞানে নতুন ধারা শুরু করেন। পশ্চিমারা যাকে Sphasa নামে চেনে। শুধু Solar Apogee নিয়ে তাঁর চার শ’র বেশি পর্যবেক্ষণ রয়েছে।

১০. ইবনে রুশদ : আবুল ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে রুশদ কর্ডোভায় ১১৬২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। জগদ্বিখ্যাত এই দার্শনিক একই সঙ্গে ফিকহ, হাদিস, কালামশাস্ত্র, দর্শন, চিকিৎসা ও গণিতে পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর যৌবনকালের বেশির ভাগ সময় স্পেন ও মরক্কোর বিভিন্ন রাজ দরবারে কেটেছে। তিনি ছিলেন মুসলিম বিশ্বে গ্রিক দর্শনের মুখপাত্র। অ্যারিস্টোটলের ‘আল হাইওয়ান’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা গ্রন্থ রচনা করেছেন ইবনে রুশদ। তামিরে হায়াত অবলম্বনে

captcha