IQNA

ঘটনাবহুল ৫ মহররম এবং হুসাইনি বিপ্লবের মহান উদ্দেশ্য ও অনন্য বৈশিষ্ট্য

13:03 - September 16, 2018
সংবাদ: 2606735
১৩৭৯ বছর আগে ৬১ হিজরির এই দিনে (৫ মহররম) বসরা ও কুফায় নিযুক্ত ইয়াজিদের গভর্নর ইবনে জিয়াদের নির্দেশে হাসিইন বিন নুমাইর চার হাজার (মতান্তরে ৩৮০০) অশ্বারোহী সেনা নিয়ে কারবালায় আসে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) এবং তাঁর সঙ্গীদের ক্ষুদ্র দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে।

ঘটনাবহুল ৫ মহররম

বার্তা সংস্থা ইকনা: একই দিনে জিয়াদ শাবাশ বিন রবি নামের এক ব্যক্তিকে এক হাজার সেনাসহ কারবালায় পাঠায়।

এ ছাড়াও সে 'জাহর বিন কাইস' নামের এক ব্যক্তিকে ৫০০ সেনাসহ কারবালা ময়দান-সংলগ্ন ফোরাত নদীর শাখার একটি সেতুর ওপর এ দায়িত্বে নিয়োজিত করে যে, কেউ যদি ইমাম হুসাইন (আ.)’র পক্ষে যুদ্ধ করতে কারবালায় প্রবেশ করে তাকে সে হত্যা করবে। কিন্তু 'সা'দা' নামের ওই সেতুর ওপর প্রহরা সত্ত্বেও ইমামের অনুরাগী ঘোড়-সওয়ার আমের বিন আবি সালামাহ ৫ মহররম নিজের ঘোড়া নিয়ে একাই জাহরের বাহিনীর ওপর বীর-বিক্রমে হামলা চালান এবং ইয়াজিদ বাহিনীর প্রতিরক্ষা-ব্যুহে ভাঙ্গন ধরিয়ে ইমাম-শিবিরে যোগ দিতে সক্ষম হন। এই মহান বীর আশুরার দিনে শাহাদত বরণ করেন।

আগের দিন ৪ মহররম, উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ কুফার মসজিদে তার বক্তব্যে বলেঃ হে কুফাবাসী! তোমরা আবু সুফিয়ানের বংশধরদেরকে চিনতে পেরেছ, তারা যা চায় তা-ই করতে পারে!! এজিদকে চিনতে পেরেছ সে চাইলে তোমাদেরকে ক্ষমাও করতে পারে! সে আমাকে নির্দেশ দিয়েছে আমি তোমাদেরকে অর্থ দান করি যেন তোমরা হুসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাও।

এ অবস্থায় ইয়াজিদ বাহিনীর পক্ষে শিমার চার হাজার প্রশিক্ষণ-প্রাপ্ত সৈন্য বাহিনী নিয়ে, ইয়াযিদ বিন রেকাব দুই হাজার সৈন্য নিয়ে, হাসিইন বিন নুমাইর চার হাজার সৈন্য নিয়ে ও মাযায়ের বিন রাহিয়ে চার হাজার সৈন্য নিয়ে এবং নাসর বিন হারসা দুই হাজার সৈন্য নিয়ে কারবালার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এভাবে ৫ মহররম কুফা শহরে বিভিন্ন স্থান থেকে ওমর বিন সাআদের সেনাদলে যোগ দেয়ার জন্য লোকেরা জমা হতে থাকে।

কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ.)'র সঙ্গে নিজ পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনসহ যারা শেষ পর্যন্ত ছিলেন ও ইয়াজিদি বাহিনীর বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০ জন। তাঁদের মধ্যে ৭২ জন শাহাদত বরণ করেছিলেন আশুরার দিন তথা দশই মহররম এবং সব শেষে একই দিনে ইমাম হুসাইন (আ.)ও শাহাদত বরণ করেন। তাঁদের সবার ওপর অশেষ সালাম ও দরুদ বর্ষিত হোক।

উল্লেখ্য জাহেলি যুগেও আরব মুশরিক ও কাফিররা মহররম মাসে (সাধারণত) যুদ্ধ-বিগ্রহ করত না। কিন্তু উমাইয়া শাসনামলে মুসলমান নামধারী শাসকরা এতটাই হীন ও নীচ হয়ে পড়েছিল যে তারা রাসূলের(সা.) নাতি ও তাঁর পরিবারকে পবিত্র মহররম মাসেই নৃশংসভাবে শহীদ করতে কুণ্ঠিত হয়নি।

ইমাম হুসাইন (আ)'র আন্দোলনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য ও অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা দেয়া বা নিষেধ করা।

ইমাম হুসাইনের (আ.) আন্দোলনে‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকারের’ উপস্থিতি এই আন্দোলনকে যেমন একটা মহান আদর্শে পরিণত করেছে ঠিক তেমনিভাবে এ আন্দোলন,‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’কে বেশি গুরুত্ববহ করে তুলেছে। ইসলামের এই রোকন ইমাম হুসাইনের (আ.) আন্দোলনকে শুধু ইসলামী বিপ্লবের শীর্ষেই আসন দান করেনি ,বরং যুগ যুগ ধরে বিপ্লবী মুসলমানদের জন্যে অনুকরণীয় আদর্শে রুপান্তরিত করেছে। তেমনিভাবে হুসাইনী আন্দোলনও সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধকে ইসলামের মূল ভিত্তিগুলোর প্রথম সারিতে স্থান করে দিয়েছে।

ইসলামে নামায,রোযা,হজ্ব,যাকাত ইত্যাদি রোকনগুলোর মত‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকারও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি । কিন্তু নামায রোযা আর হজ্ব এগুলো নিয়ে মুসলমানরা মশগুল হয়ে পড়েছিল। ক্রমে ক্রমে ইসলামের অন্য ভিত্তিগুলো একবারে ভুলেই যাচ্ছিল মুসলমানরা। অথচ নামায কিংবা রোযার মত‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’ -এর গুরুত্বও কোনো অংশে কম নয়।

ইমাম হোসাইন (আ.) প্রমাণ করেছেন যে,জায়গা বিশেষে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকারের জন্যে জানমাল উৎসর্গ করতে হয়। সেদিন অনেকেই ইমামের এই আন্দোলনকে সঠিক ও উপযুক্ত পদক্ষেপ বলে মেনে নিতে পারেনি। অবশ্য তাদের চিন্তার মান অনুযায়ী তাদের এই আপত্তি করাটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ইমাম হোসাইনের (আ.) চিন্তার মান এসবের অনেক উর্দ্ধে ছিল। অন্যেরা বলছিল যে,ইমাম যদি ইয়াযিদের বিরোধিতায় নামেন পরিণতিতে ইমাম জানমাল হারাবেন। ইমাম (আ.) নিজেই আশুরার দিনের অবস্থা দেখে ইবনে আব্বাসকে বলেন :

‘ সাবাস! তুমি ভালই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারো।’ কারণ,ইমাম যখন মদীনা থেকে রওয়ানা হন তখন ইবনে আব্বাস বলেছিলেনঃ‘ আমার দৃঢ় বিশ্বাস,কুফাবাসীরা আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে,অনেকেই সেদিন এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। কিন্তু ইমাম জবাবে বলেছিলেন :

‘ তোমরা যা বলছো তা আমার অজ্ঞাত নয়,আমিও তা জানি।’

মূলতঃ ইমাম হোসাইন (আ.) বিশ্বকে বোঝালেন যে,‘ আমর বিল মারুফ এবং নাহী আনীল মুনকারের’ জন্যে জীবনও দেয়া যায়,ধন-সম্পদ সবকিছু উৎসর্গ করা যায়। ইসলামের এই ভিত্তিটির জন্যে পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো ব্যাক্তি কি ইমাম হোসাইনের (আ.) ন্যায় আত্মত্যাগ করতে পেরেছে? ইমাম হোসাইনের (আ.) আন্দোলনের অর্থ হয় যে,‘আমর বিল মারুফ এবং নাহী আনীল মুনকারের’ মূল্য এত বেশী যে তার জন্যে এ ধরনের আত্মত্যাগও করা যায়।

যেদিন ইমাম মক্কা ছেড়ে আসেন সেদিন মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়ার কাছে লেখা অসিয়তনামায় তিনি এ বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি লিখেন :

‘‘ আমি কোনো ধন-সম্পদ বা ক্ষমতার লোভে কিংবা কোনো গোলযোগ সৃষ্টির জন্যে বিদ্রোহ করছি না,আমি শুধু আমার নানার উম্মতের মধ্যে সংস্কার করতে চাই,আমি‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’ করতে চাই এবং আমার নানা যে পথে চলেছেন আমিও সেই পথে চলতে চাই।’’ ( দ্রঃ মাকতালু খারাযমীঃ ১ / ১৮৮ )

ইমাম হোসাইন (আ.) দীর্ঘ পথ চলার সময় একাধিকবার তার এই লক্ষ্যকে পুনঃ পুনঃ উল্লেখ করেন। বিশেষ করে এ সময়গুলোতে তিনি বাইয়াত প্রসঙ্গেরও যেমন কোনো উল্লেখ করেননি তেমনি দাওয়াত প্রসঙ্গেরও কোনো উল্লেখ করেননি। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল পথিমধ্যে তিনি যতই কুফা সম্পর্কে ভয়ানক ও হতাশাব্যঞ্জক খবর শুনছিলেন ততই তার বক্তব্য জ্বালাময়ী হয়ে উঠছিল। সম্ভবতঃ ইমামের দূত মুসলিম ইবনে আকীলের শহীদ হবার সংবাদ শুনেই ইমাম এই বিখ্যাত খোতবা প্রদান করেনঃ

‘ হে মানবমণ্ডলী! পৃথিবী আমাকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করছে,আমাকে বিদায় জানাচ্ছে । পরকাল আমাকে সাদরে বরণ করছে,উপযুক্ত মর্যাদা দিচ্ছে ।’

‘‘ তোমরা কি দেখতে পাচ্ছনা যে সত্য অনুসারে আমল করা হচ্ছে না,তোমরা কি দেখতে পাও না যে আল্লাহর বিধানসমূহকে পদদলিত করা হচ্ছে ? দেখতে পাওনা যে চারদিকে ফেতনা-ফ্যাসাদে ছেয়ে গেছে অথচ কেউ এর প্রতিবাদ করছে না?’’

‘‘ এ অবস্থায় একজন মুমিনের উচিত নিজের জীবন উৎসর্গ করে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করা। যদি জীবন উৎসর্গ করতে হয় তাহলে এটাই তার উপযুক্ত সময়।’’ ( দ্রঃ তুহফাল উকুলঃ ২৪৫ )

অর্থাৎ‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’ এতই মূল্যবান। পথিমধ্যে উচ্চারিত অন্য আরেকটি খোতবায় ইমাম সার্বিক অবস্থার বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেনঃ

‘‘ হে লোকসকল! আমি এই পরিস্থিতিতে মৃত্যুবরণকে কল্যাণ ও মর্যাদাকর ছাড়া আর কিছুই মনে করি না।’’ অর্থাৎ একে আমি সত্যের জন্যে শহীদ হওয়া মনে করি। এ থেকে বোঝা যায় যে‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’ করতে গিয়ে নিহত হলে সে শহীদের মর্যাদার অধিকারী হবে। .

‘‘ আর জালেমদের সাথে বেঁচে থাকাকে আমি নিন্দাকর অপমান মনে করি। আমার আত্মা এমন আত্মা নয় যে,জালেমদের সাথে আপোষ করে বেঁচে থাকতে পারবে।’’

ইমাম এর চেয়েও আরো বড় কথা বলেন যখন অবস্থা শতভাগ প্রতিকূল হয়ে ওঠে। কাফেলা যখন ইরাকের সীমানায় পৌঁছায় তখন হুর ইবনে ইয়াযিদ আর-রিয়াহীর এক বিশাল বাহিনীর বাধার সম্মুখীন হন। হুর এক হাজার সৈন্যযোগে ইমামের কাফেলাকে বন্দী করে কুফায় নিয়ে যাবার দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিল। তাবারীর মতো বিশ্বস্ত ঐতিহাসিকগণ ঐ মুহুর্তে ইমামের সেই বিখ্যাত খোৎবার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। ইমাম ঐ খোতবায় রাসূলুল্লাহর (সা.) উদ্ধৃতি দিয়ে‘ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহী আনীল মুনকার’ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন :

(তিনি দুটো পরিপূর্ণ সূত্রের সাহায্য নেন। প্রসিদ্ধ নিয়মানুযায়ী তিনি প্রথমে একটা সাধারণ সূত্রের উল্লেখ করেন)‘‘ হে লোকসকল! রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ‘ যদি কেউ কোনো অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী সরকারকে দেখে যে হালালকে হারাম করে,হারামকে হালাল করে,বায়তুলমালকে নিজের ব্যাক্তিগত খাতে খরচ করে,আল্লাহর বিধি-বিধানকে পদদলিত করে,মুসলমানের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করে না,এরপরও যদি সে নিশ্চুপ বসে থাকে তাহলে আল্লাহ তাকে ঐ জালেমদের সাথে একই শাস্তি প্রদান করবেন।

আজকে যারা (বনি উমাইয়ারা) হুকুমত করছে তারা কি ঐসব জালেম ও স্বৈরাচারীদের মতন নয়? দেখতে পাও না যে তারা হালালকে হারাম করেছে আর হারামকে হালাল? তারা কি আল্লাহর বিধানকে পদদলিত করেনি? বায়তুলমালের অর্থকে তারা কি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেনি? আত্মসাৎ করেনি? তাই এরপরও যারা নীরবতা অবলম্বন করবে তারাও ইয়াযিদদের মতোই বলে সাব্যস্ত হবে।’’ এবার তিনি নিজের প্রসঙ্গে বলেন :

আর আমার নানার এই আদেশ পালন করতে অন্যদের চেয়ে আমিই বেশী যোগ্য,আমারই দায়িত্ব অধিক ।’’ ( দ্রঃ তারিখে তাবারীঃ ৪ / ৩০৪ )

কোনো মানুষ যখন ইমাম হোসাইনের (আ.) এসব বৈশিষ্ট্যের সাথে পরিচিত হয় তখন বলে যে,এ ধরনের ব্যক্তিই তো চির ভাস্বর হয়ে থাকার অধিকার রাখেন। তিনিই তো চিরঞ্জীব থাকার যোগ্য । কেননা হোসাইন নিজের জন্যে ছিলেন না। তিনি নিজেকে মানুষ ও মানবতার জন্যে উৎসর্গ করেছেন। একত্ববাদ,ন্যায়পরায়ণতা এবং মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। আর এ কারণেই সব মানুষই তাকে ভালবাসে,তাকে শ্রদ্ধা করে। যখন কোনো মানুষ এমন একজনকে দেখে যার নিজের জন্যে কিছুই নেই,মান-সম্মান,মর্যাদা,মানবতা যা আছে তা সবই অন্যের জন্যে -তখন সে নিজেকে ঐ ব্যক্তির সাথে একাত্ম করে নেয়।

হুর ইমাম হোসাইনের (আ.) সাথে সাক্ষাতে ইমামকে কুফায় নিয়ে যাবার প্রস্তাব করলে ইমাম এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি কখনো অপমানের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাননি। মনুষ্যত্বের মাহত্ম্য ও মর্যাদাকেই তিনি অক্ষুণ্ণ রাখতে চেয়েছেন। তিনি বললেনঃ আমি যাব না। শেষ পর্যন্ত আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে,তিনি এমন এক রাস্তায় যাবেন যে রাস্তা কুফারও নয়,মদীনারও নয়। অবেশেষ তিনি মহররম মাসের দুই তারিখে কারবালা ভূখন্ডে এসে পৌঁছুলেন। প্রায় ৭২ জন সঙ্গী-সাথীসহ সেখানে তাঁবু গাড়লেন। ওদিকে হুরের বাহিনীও কিছুদূরে তাঁবু গাড়লো। কুফার গভর্ণরের দূতরা অনবরত যাওয়া-আসা শুরু করলো। পরের দিনগুলোতে শত্রুদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো এবং নতুন নতুন বাহিনী এসে উপস্থিত হল। এক হাজার,পাঁচ হাজার এভাবে ৬ তারিখের দিনের বেলা ত্রিশ হাজারে পৌঁছলো।

কুফার গভর্ণর ইবনে যিয়াদ এই বিশাল বাহিনীর দায়িত্ব ভার ইবনে সা’ দের হাতেই সোপর্দ করলো। ইবনে যিয়াদের ধারণা ছিল ইবনে সা’ দই তাকে হুকুমত এবং ইমারত লাভে সফল করবে। মোদ্দকথা ইবনে যিয়াদ এমন একজনকে নির্বাচিত করলো যাকে দেখে মুসলমানরা মনে করে যে,(নাউযুবিল্লাহ) ইবনে সা’ দ অতীতের মতোই যারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে তাদের সাথে যুদ্ধে নেমেছে। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে ইবনে সা’ দ কাফেরদের বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধে অংশ নিয়ে বেশ খ্যাতি লাভ করেছিল। অবশ্য ইবনে যিয়াদ যে ইবনে সা’ দকে ব্যাবহার করতে চাচ্ছে একথা ইবনে সাদ ধরে ফেলেছিল। তাই সে ইবনে যিয়াদের কাছে গিয়ে এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাইলো। কিন্তু ইবনে যিয়াদও ইবনে সা’ দের দুর্বলতা কোথায় তা ভাল মতো জানতো। তাই আগেই একটা ডিক্রীপত্রে ইবনে সা’ দের জন্যে গুরগান ও রেই প্রদেশের গভর্ণর পদে নিযুক্তিরকথা লিখে রেখেছিল। এ কারণে ইবনে সা’ দ যখন দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানাতে আসে তখন ইবনে যিয়াদ বলেঃ ঠিক আছে,তাহলে মনে হে এই ডিক্রীপত্রটা এখন অন্য জনের নামে লিখতে হয়! ইবনে সা’ দ এবার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দ্বন্দে ভুগতে লাগলো। কারণ এ ধরনের একটা গভর্ণরের পদ তার বহু দিনের খায়েশ। ইবনে সা’ দ বললো,আমাকে একটু অবসর দাও,একটু ভেবে নেই। ইবনে সা’ দ যার সাথেই আলোচনা করলো সবাই তাকে নিন্দাবাদ করে বললো যে,তুমি নবীর সন্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইবনে সা’দের কামনার প্রবৃত্তি বিজয়ী হলো এবং ইবনে যিয়াদের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিল। ইবনে সা’ দ কারবালায় এসে প্রচেষ্টা করলো খোদা ও খোরমা দুটোই পেতে। সে যে কোনোভাবে ইমামকে একটা আপোষে রাজী করতে প্রচেষ্টা চালালো যাতে অন্ততঃপক্ষে নবীর সন্তানকে হত্যা করার দায় থেকে সে বাঁচতে পারে। তারপরে যাহোক দেখা যাবে। ইমাম হোসাইনের (আ.) সাথে এরপর তার দু’ -তিনটি আলোচনা অনুষ্ঠিত হল। ঐতিহাসিক তাবারী লিখেছেন যে,যেহেতু এই বৈঠকগুলো কেবল দু’ জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল-তাই কি আলোচনা হয়েছিল তা সবিস্তারে উদ্ধার করা যায়নি। কিন্তু যেটুকু ইবনে সাদ পরে ফাঁস করে তা থেকে বোঝা যায় যে,এমন কি কিছু মিথ্যা প্রলোভনের আশ্রয় নিয়ে ইবনে যিয়াদ ইমামকে আপোষে টানার জন্য যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালায়। ইবনে সা’ দের সর্বশেষ চিঠি যখন ইবনে যিয়াদের হাতে পৌঁছলো তখন কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ ও তার পাশে বসে ছিল। এ চিঠি পড়ে ইবনে যিয়াদ বললো যে হয়তো ব্যাপারটির শান্তিপূর্ণ সামাধান সম্ভব। কিন্তু তার চারপাশের ইবলিসী দালালদের মধ্যে থেকে শিমার ইবনে যিল জুউশান বলে উঠলোঃ

‘‘ হে আমীর! তুমি একটা অমার্জনীয় ভুল করতে যাচ্ছ । ইমাম হোসাইন (আ.) এ মুহুর্তে তোমার হাতের মুঠোয়। এখান থেকে যদি তাকে ছেড়ে দাও তাহলে পরে তাকে আর নাগালে আনা সহজ হবে না। এ দেশে হযরত আলী (আ.)-এর অনুসারী কম নেই। তারা কেবল কুফায় নয়। তুমি কি বুঝবে না যে,আশপাশ থেকে ইমাম হোসাইনের (আ.) অনুসারীরা তার সাথে যোগ দেব? আর যদি সত্যিই ইমাম হোসাইনের (আ.) অনুসারীরা তার সাথে যোগ দেয় তাহলে তোমার দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে না। ইতিহাসে আছে যে,একথা শুনে ইবনে যিয়াদের যেন টনক নড়ে উঠলো। বললোঃ হ্যাঁ ঠিকই তো। এরপর সে ইবনে সা’ দের চিঠির জন্যে তাকে অভিসম্পাত করে বললো,ইবনে সা’ দ যে আমাকে প্রায় ঠকিয়ে দিয়েছিল। এরপর সে ইবনে সা’ দকে লিখে পাঠালো,আমি তোমাকে পাঠিয়েছি আমার হুকুম পালন করবার জন্যে,আমাকে তুমি পিতার মতো উপদেশ লিখে পাঠাবে এ জন্যে তো নয়! তুমি একজন সেনা প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছো,শৃঙ্খলা মেনে চলো আর কোনো টু’ শব্দ ছাড়াই আমার আদেশ পালন করো। যদি এ কাজ না পারো তাহলে বলো,আমি অন্য আরেকজনকে নিয়োগ করবো। ইবনে যিয়াদ শিমারের মাধ্যমে এই চিঠিতে একটা আদশনামা লিখে বললো,ইবনে সা’ দ যদি হোসাইনের (আ.) সাথে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে শিমার (শিমার) এই আদেশনামার জোরে তার শিরচ্ছেদ করবে। তারপর সেনা প্রধানের দায়িত্ব তোমার হাতেই থাকবে।

লিখিত আছে যে ৯ মহররমের বিকালে ইবনে সা’ দের হাতে এ চিঠি পৌঁছায়। শিমার চিঠিটি ইবনে সা’ দকে দিল। শিমারের আশা ছিল যে,ইবনে সা’ দ বলে উঠবে,না! আমি নবীর সন্তানকে হত্যা করতে পারবো না।

তাহলেই শিমার ঐ গোপন আদেশনামার জোরে তার শিরচ্ছেদ করে সে নিজেই সেনাপতি হতে পারবে। কিন্তু ইবনে সা’ দ শিমারের মিথ্যা আক্ষেপের অবসান ঘটিয়ে বলে উঠলোঃ আমার ধারণা ছিল যে,আমার চিঠি পড়ে ইবনে যিয়াদের হুশ আসবে। কিন্তু তুমি তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তা হতে দাওনি।

শিমার বললঃ আমি ওসব কিছু বুঝি না। শুধু শুনতে চাই যে,শেষ পর্যন্ত তুমি যুদ্ধ করতে রাজী আছা কিনা। ইবনে সা’ দ এবার বললোঃ অবশ্যই করবো। এমন যুদ্ধ করবো যাতে হাত-পা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে আকাশে নিক্ষিপ্ত হবে।

শিমার বললঃ ঠিক আছে। তাহলে এখন আমার দায়িত্ব কি?

ইবনে সা’ দ জানতো যে ইবনে যিয়াদের কাছে শিমারের ভালই কদর রয়েছে। তাই শিমারকে বললোঃ তুমি হবে পদাতিক বাহিনীর কমান্ডার।

৯ মহররমের ঐ চিঠিতে কড়া আদেশ লেখা ছিল। ইবনে যিয়াদ লিখেছিল : আমার চিঠি পৌঁছানোর সাথে সাথেই ইমাম হোসাইনকে (আ.) জোর অবরোধের মধ্যে ফেলবে। ইমাম হোসাইনকে (আ.) হয় আত্মসমর্পণ করতে হবে নতুবা যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হতে হবে। এর বাইরে তৃতীয় কোনো পথ নেই। ইবনে সা’ দ এই আদেশ পেয়ে ইমামের তাবুগুলোর চারপাশে সেনা মোতায়েন করে জোর অবরোধ সৃষ্টি করলো। ইমাম হোসাইন (আ.) তাদের এ ধরনের চাল-চলন দেখে হযরত আব্বাসকে যুহাইর ইবনে কাইন এবং হাবিব ইবনে মাযাহিরের সাথে পাঠিয়ে কি খবর জেনে আসতে বললেন। হযরত আব্বাস,নতুন কোন সংবাদ আছে কি?

ইবনে সা’ দ বললোঃ হ্যাঁ,ইবনে যিয়াদ আদেশ পাঠিয়েছে যে,ইমাম হোসাইনকে (আ.) হয় আত্মসমর্পণ করতে হবে আর নয়তো যুদ্ধের পথ বেছে নিতে হবে।

হযরত আব্বাস বললেনঃ আমি নিজের পক্ষ থেকে তো কোনো জবাব দিতে পারি না। ঠিক আছে,আমি ইমামের বক্তব্য জেনে এসে তোমাদেরকে বলছি।

হযরত আব্বাস ইমাম হোসাইনের (আ.) কাছে ফিরে এসে ব্যাপারটা জানালেন।

ইমাম জবাবে বললেনঃ আমরা আত্মসমর্পণ করি না। যুদ্ধই আমরা করবো শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত । তবে ওদেরকে গিয়ে শুধু একটা কথাই বলো,শুধু একটা অনুরোধ করো যে,কাল সকাল পর্যন্ত আমাদের সময় দেয়া হোক। অনেকে হয়তো বলতে পারে যে,ইমাম হোসাইন (আ.) বেঁচে থাকতে খুবই ভালবাসতেন। তাই ঐ এক রাতকে জীবনের জন্যে গনীমত হিসাবে পেলেন। কিন্তু ইমাম নিজেই বলছেনঃ‘‘ স্বয়ং আল্লাহ জানেন আমি এই অবসরটুকু কি জন্যে চেয়েছি। আমার মন-প্রাণ শেষবারের মতো একবার আল্লাহর সাথে অনুনয়-বিনয় করতে চায়। শেষবারের মত নামায পড়তে,দোয়া ও মোনাজাত করতে এবং কোরআন তেলাওয়াত করতে চায়। এই রাতটাকে জীবনের শেষ রাত হিসাবে আমি আল্লাহর ইবাদত করতে চাই।’’

হযরত আব্বাস ফিরে এসে ইবনে সা’ দকে ইমামের মতামত জানালেন এবং ইমামের অনুরোধ ও বললেন। তারা অনেকেই ইমামের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে চাইলো। কিন্তু অনেকে এর প্রতিবাদ করে বললো যে-তোমরা সত্যিই বেশরম। যখন কাফেরদের সাথে যুদ্ধ হতো তখন তারা যদি এরকম প্রস্তাব দিত তাহলে তা গ্রহণ করা হতো। আর নবীর সন্তান শেষবারের মতো আল্লাহর ইবাদত করার জন্যে একটা রাত অবসর চেয়েছে,তোমরা তা প্রত্যাখ্যান করছো! এভাবে তাদের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হলো। শেষ পর্যন্ত ইবনে সা’ দ,সৈন্যদের মধ্যে ঐক্য রক্ষারস্বার্থে ইবনে যিয়াদের আদেশকে কিছুটা উপেক্ষা করে বললোঃ ঠিক আছে,কাল সকালে!

ইমাম হোসাইন (আ.) এই আশুরার রাতে গভীর ইবাদেত নিমগ্ন হন। এক আধ্যাত্মিক,জ্যোতির্ময় এবং ঐশী পরিবেশে তিনি আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হন। যারা এই রাতকে ইমাম হোসাইনের (আ.) মে’ রাজের রাত বলে আখ্যায়িত করেছেন তারা সত্যিই যথার্থ কথাই বলেছেন। আশুরার রাতে ইমাম সব সঙ্গী-সাথীদেরকে ডেকে বললেনঃ হে আমার সহযোগীরা,হে আমার পরিজনরা! আমি আমার সহযোগী এবং আমার পরিজনদের চেয়ে উত্তম কোনো সহযোগী এবং পরিজন খুঁজে পাইনি। তোমাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমাদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ । তবে সবাই শোনো,ওরা কিন্তু কেবল আমাকেই চায়। আমাকে ছাড়া আর কারো সাথে ওদের কোনো কাজ নেই। তোমরা যদি আমার হাতে বাইয়াত করে থাকো তাহলে আমি সে বাইয়াত তুলে নিলাম,তোমরা সবাই এখন স্বাধীন। তোমাদের মধ্যে যে চলে যেতে চায় সে এখন অনায়াসেই চলে যেতে পারে। আর পারলে আমার পরিজনদের একজনকে হাত ধরে নিয়ে যাও! ইমামের মুখের দিকে চেয়ে অনেকে বিগিলত হতে পারে এ কারণে ইমাম এবার আলো নিভিয়ে দিয়ে বললেনঃ তোমরা এই অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে যেতে পার। কেউ তোমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।

ইমামের একথা শুনে সবাই এক সাথে বলে উঠলোঃ হে ইমাম,একি কথা আপনি আমাদেরকে বলছেন? আমরা আপনাকে একা রেখে চলে যাব? আমাদের সামা একটা প্রাণের চেয়ে বেশী কিছু নেই যা দিয়ে আপনাকে সাহায্য করতে পারি! আল্লাহ যদি আমাদেরকে পর পর এক হাজারটা জীবন দান করতেন এবং এক হাজার বার আমরা আপনার রাস্তায় কোরবানী হতে পারতাম এবং জীবিত হয়ে পুনঃ পুনঃ আপনার জন্যে কোরবানী হতে পারতাম! এই সামান্য একটা প্রাণ তো আপনার রাস্তায় খুবই নগণ্য । আমাদের এই নগণ্য জীবন আপনার রাস্তায় কোরবানী হবার যোগ্য নয়। বলা হয়েছেঃ

‘‘ সর্ব প্রথম যিনি একথা বলেছিলেন তিনি হলেন ইমামের বীর ভাই হযরত আবুল ফযল আল-আব্বাস।’’ ইমাম তাদেরকে এই চুড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দেখে আরো কিছু নতুন সত্যের পর্দা খুলে দিলেন। তিনি বললেনঃ এখন আমি হাকিকতকে তোমাদের সামনে বলতে চাই। সবাই জেনে রাখ যে,আগামীকাল আমরা সবাই শহীদ হবো।

আমাদের মধ্যে কেউই বেঁচে থাকবে না। সবাই বলে উঠলোঃ আল্লাহকে লাখো শোকর যে,এ ধরনের একটা শাহাদাতের মর্যাদা আমাদেরকে দান করেছেন। যখন ইমাম হোসাইন (আ.) শাহাদাতের এই সুসংবাদ ঘোষণা করলেন তখন ১৩ বছরের একটা বালকও এই মজলিসে বসেছিলেন। তিনি ছিলেন ইমাম হাসানের পুত্র কাসেম। তিনি খুবই চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েন,ইমাম যে শাহাদাতের কথা বললেন তা বোধহয় কেবল বড়দের ভাগ্যেই আছে। আমি হয়তো এর শামিল হতে পারবো না। ১৩ বছরের বালক,এ ধরনের চিন্তা করাই স্বাভাবিক। তিনি গভীর চিন্তা করতে করতে এক সময় মাথা তুলে বললেনঃ

‘‘ হে চাচাজান,আমিও কি আগামীকালের শহীদদের মধ্যে আছি?

ইমাম হোসাইন (আ.) একটা দয়ার্দ্র দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালেন। তারপর বললেনঃ হে প্রিয় কাসেম! আমি আগে তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি,তার জবাব দাও। তারপর তোমার প্রশ্নের জবাব দেব।

হযরত কাসেম বললেনঃ চাচাজী আপনার প্রশ্ন কি?

ইমাম জিজ্ঞেস করলেনঃ বলতো দেখি মৃত্যুস্বাদ তোমার কাছে কেমন লাগবে?

হযরত কাসেম বললেনঃ

‘‘ চাচাজী! মধুর চেয়েও মিষ্টি’’

অর্থাৎ আমি যে জিজ্ঞেস করলাম শহীদদের মধ্যে আমি আছি কিনা তার কারণ হলো যে,ভয় পাচ্ছিলাম আমি এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হই কিনা।

ইমাম বললেনঃ হ্যাঁ,কাল তুমিও শহীদ হবে।

এ ছিল সত্যের অনুসারী ইমাম হোসাইনের (আ.) সাহায্যকারীদের আত্মার একটা স্বরূপ । আমরা আগামীতে ইমাম হোসাইনের (আ.) সহযোগীদের এ অসামান্য বীরত্ব নিয়ে আলোচনা করবো।

captcha